হস্তশিল্প ও কুটির শিল্প ছিল আদি ও মধ্যযুগীয় বাংলার গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। হস্তশিল্প হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল বয়ন, ধাতব পদার্থের কাজ, জুয়েলারি, বিশেষ করে রুপার তৈরি অলঙ্কার, কাঠের কাজ, বেত এবং বাঁশের কাজ, মাটি ও মৃৎপাত্র। পরবর্তী সময়ে হস্তশিল্পপণ্য তৈরিতে পাট এবং চামড়া প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত হতে থাকে। বাংলাদেশের হস্তশিল্পপণ্যে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, সৌন্দর্য এবং নৈপুণ্য বিদ্যমান।
হস্তশিল্প হাতের তৈরি নানাবিধ পণ্য উৎপাদনের ক্ষুদ্রায়তন ইউনিট। গৃহের মালিক নিজে এবং পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় বা ১০ জন পর্যন্ত বেতনভুক্ত কর্মচারী নিয়ে যন্ত্র বা যন্ত্রপাতি ছাড়া এসব পণ্য প্রস্ত্তত করে থাকে। কতিপয় হস্তশিল্প পণ্য রয়েছে যেগুলির কিছু অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এসব বৈশিষ্ট্যের উৎস হচ্ছে একটি অঞ্চল বা দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বা কারুশিল্পীদের বিশেষ উৎপাদন কৌশল।
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, গাঙ্গেয় অববাহিকার মসলিন বস্ত্র রোমান এবং গ্রিক সাম্রাজ্য পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। চীনা এবং আরব পর্যটকগণও বঙ্গদেশে উৎপাদিত উচ্চমানের সুতি এবং রেশমি বস্ত্রের কথা জানতেন। ষোড়শ শতাব্দী থেকে বঙ্গদেশের উচ্চমানের হাতেবোনা বস্ত্র, উন্নতমানের গজদন্ত, রুপা এবং অন্যান্য ধাতুর তৈরি কারুপণ্য মুগল দরবারেও সমাদৃত হয়েছিল। মুগল সম্রাটগণ শিল্পকারুপণ্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তারা কারিগর সম্প্রদায়কে সাজসজ্জা এবং উপঢৌকনের দ্রব্যাদি তৈরির কাজে নিয়োগ করেছিলেন। মুগল শাসনের প্রথমদিকে নিপুণ কারিগরদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার উৎসাহ দিয়ে তাদের বাড়তি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হতো। এরা দিল্লীর সম্রাটের দরবারের জন্য দুর্লভ এবং উচ্চমানের উপহার দ্রব্য তৈরি করত। শাসকশ্রেণি এবং অভিজাতশ্রেণি এ সমস্ত দ্রব্য ব্যবহার করত বলে হস্তশিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। হস্তশিল্প তৈরিতে কারিগরগণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তারা মূলত তাদের পরিচিত লোকদের জন্য কাজ করত এবং এই কারণেই তাদের উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে লক্ষণীয়ভাবে ব্যক্তিগত রুচি এবং আন্তরিকতার ছাপ থাকত।
বাংলাদেশের হস্তশিল্পগুলি অধিকাংশই গ্রামীণ এলাকার একেকটি পণ্য উৎপাদন ইউনিট। এ সব ইউনিটে সনাতন পদ্ধতিতে পণ্য তৈরি করা হয়। পণ্য তৈরিতে দেশীয় কাঁচামাল, যেমন বাঁশ, পাট, কাঠ, বেত, খড়, ঘাস, মাটি ইত্যাদি ব্যবহূত হয়। হস্তশিল্পীরা ক্রমাগত অধিক পরিমাণে চামড়া, বয়ন, পিতল, তামা, রুপা ব্যবহার করছে। এ সব কাঁচামাল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মনোমুগ্ধকর ঝুড়ি, মৃৎপাত্র, দেওয়ালে ঝুলানোর সামগ্রী, হাত ব্যাগ, ভ্রমণ ব্যাগ, খেলনা, ছাইদানি, কার্পেট, নকশি কাঁথা ইত্যাদি তৈরি করা হয়। এ সব পণ্য ব্যবহারের উপযোগী, টেকসই এবং পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এগুলির নান্দনিক এবং কারিগরি অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ঘরে ও বাইরে নানা কাজে এগুলি ব্যবহূত হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে হ্যান্ডিক্রাফটসের সম্ভাবনা অনেক। কারণ, এখানে অল্প টাকায় দক্ষ শ্রমিক পাওয়া যায়। তাই দেশের চাহিদা মিটিয়ে প্রচুর পরিমাণে হ্যান্ডিক্রাফটস বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে দেশে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুারোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে হ্যান্ডিক্রাফটস রপ্তানির পরিমাণ ছিল এক কোটি ৪০ লাখ ডলার। আর পুরো বছরে রপ্তানি হয় এক কোটি ৬৭ লাখ ডলার। অন্যদিকে গত অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে রপ্তানি হয়েছে এক কোটি ৭১ লাখ ডলারের হ্যান্ডিক্রাফটস পণ্য। ফলে দশ মাসেই উচ্চ প্রবৃদ্ধি এসেছে এ খাত থেকে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি এবং তার আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২১ দশমিক ৮৮ শতাংশ বেশি।
দেশীয় তৈরী হস্তশিল্প দিয়ে ঘর সাজানো থেকে শুরু করে আসবাবপত্র ও বিভিন্ন নকশি ডিজাইন এখন সবার নজর কাড়ছে। বিক্রিও হচ্ছে দেদার। শুধু তাই নয়, এসব পণ্যের কদর দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও বিক্রি হচ্ছে। তবে হস্তশিল্পের যে অসীম সম্ভাবনা রয়েছে সেটা আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। এর প্রধান কারণ হলো কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো প্রদর্শনব্যবস্থা না থাকায় আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে এসব পণ্যের অধিকাংশই পৌঁছায় না। এছাড়া পণ্যের নকশা, কারুশিল্পীদের প্রশিক্ষণ ও গবেষণার জন্য নেই কোনো প্রতিষ্ঠানও। সরকারের দিক থেকে এসব সমস্যা সমাধানে জোরালো উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন।
চীন, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড মুলত হ্যান্ডিক্রাফটস উৎপাদনের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত, তারা এখন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রির দিকে যাচ্ছে। ফলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান শক্ত করার সুযোগ আছে। আগে এসব পণ্যের ক্রেতা বাংলাদেশে আসত না, এখন তারা বাংলাদেশে আসছেন। তাই বিভিন্ন আঙ্গিকে এসব পণ্যের বাজার তৈরি হচ্ছে । বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশে বর্তমানে হ্যান্ডিক্রাফটস রপ্তানি হচ্ছে। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো মূলত বাংলাদেশের হ্যান্ডিক্রাফটের বড় বাজার।
পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দেশের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবং বিশ্বসমাজে স্বদেশের পরিচিতি সম্প্রসারণে হস্তশিল্প রপ্তানি এক বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। হস্তশিল্প সৃষ্টি হয় চিত্রশিল্পী, ভাস্কর এবং কারুশিল্পীর কর্ম থেকে যাদের শিল্পী হিসেবে বস্ত্তত কোন প্রশিক্ষণই থাকে না। তাদের সৃষ্ট হস্তশিল্প দেশের ঐতিহ্য ধরে রাখতে জাদুঘরে মূল্যবান চিত্রকর্ম হিসেবে রক্ষিত না হয়ে বরং অন্য লোকদের জন্য ব্যবহারিক উপযোগ সৃষ্টি করে। শিল্পিগণ সাধারণ লোকের প্রয়োজন মেটানোর পর ধনী ও অভিজাত লোকদের পৃষ্ঠপোষকতায় কারুশিল্পীর মর্যাদা অর্জন করে। কুটির শিল্প পর্যায়ে কারুশিল্প পরিবারের সদস্যগণ বা সমবায়ের সদস্যগণ হস্তশিল্প উৎপাদনে নিযুক্ত হয়। পরিবারের শ্রমিকগণ ছাড়াও কিছুসংখ্যক ভাড়া করা দক্ষ ও আধাদক্ষ শ্রমিকদের দৈনিক পারিশ্রমিক ভিত্তিতে এ কাজে নিযুক্ত করা হয়। গ্রামীণ এলাকায় এটি কর্মসংস্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। এশিয়ার সাতটি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করে এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ৪ মিলিয়ন লোক পূর্ণাঙ্গভাবে হস্তশিল্প উৎপাদনে নিয়োজিত এবং আরও ৪ মিলিয়ন লোক এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খন্ডকালীন কাজে নিয়োজিত।